তিস্তা ব্যারাজে ত্রিমুখী সংকট টোলের নামে চাঁদাবাজি : রাজস্ব যাচ্ছে কার পকেটে?

আপলোড সময় : ২৪-০৮-২০২৫ ০১:৪৭:১৩ অপরাহ্ন , আপডেট সময় : ২৪-০৮-২০২৫ ০৪:৩৬:৫৬ অপরাহ্ন

জহুরুল ইসলাম, নীলফামারী: 
উত্তরাঞ্চলের কৃষির প্রাণ তিস্তা ব্যারাজ এখন পরিণত হয়েছে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, মাদক ও জমি দখলের অভয়ারণ্যে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় এই ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। সময় থাকতে ব্যবস্থা না নিলে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প হারাতে বসবে তার ম‚ল উদ্দেশ্য- কৃষকের জীবন বাঁচানো আর খরা পীড়িত জনপদে সেচের পানি পৌঁছে দেওয়া।
 

২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে ব্যারাজের ২৪, ২৭ ও ২৮ নম্বর গেটে ফাটল দেখিয়ে প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান ভারী যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেন। কাগজে-কলমে টোল আদায় বন্ধ হলেও বাস্তবে শুরু হয় চাঁদাবাজির নতুন অধ্যায়। স্থানীয়দের সাক্ষ্য ও গোপন কাগজপত্রে উঠে আসে- প্রতিটি ট্রাক থেকে ওঠা টাকার ভাগ পৌঁছাত সাবেক সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেন ও তার ছেলে মাহমুদুল হাসান সোহাগের কাছে। বর্তমানে হাতবদল হলেও গোড্ডিমারি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আতিয়ার রহমান, তার ছেলে সিদ্দিকুর রহমান শ্যামল এবং নীলফামারী-১ আসনের সাবেক সংসদ আফতাব উদ্দিন সরকারের নেতৃত্বে এ সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে।
 

প্রকৌশলীদের নকশা অনুযায়ী ব্যারাজ সর্বোচ্চ ২০ টন ভার বহনে সক্ষম। কিন্তু প্রতিদিন ৩০-৪০ টন মালবোঝাই ৩০০-৩৫০টি ট্রাক ব্যারাজ দিয়ে চলাচল করছে। এক আনসার সদস্য বলেন, প্রতিটি ট্রাক থেকে মোটা অংকের টাকা ওঠে। আমরা শুধু দায়িত্ব পালন করি, আসল ভাগ যায় উপরের দিকে। 
 

সরকারি নথি বলছে, ব্যারাজ থেকে ৫ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার কথা। কিন্তু মাঠঘাট ঘুরে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ ২৫-৩০ হাজার হেক্টরে পানি পৌঁছায়। সেচ ক্যানেলগুলো দখল হয়ে গেছে প্রভাবশালীদের হাতে- কোথাও বাজার, কোথাও বহুতল ভবন। অথচ পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা “রক্ষণাবেক্ষণ খাতে” খরচ দেখাচ্ছে।
 

আইন অনুযায়ী ব্যারাজের এক কিলোমিটার আশপাশে কোনো খনিজ উত্তোলন চলার কথা নয়। কিন্তু ক্যামেরায় ধরা পড়েছে ব্যারাজের গা ঘেঁষে বোমা মেশিন বসিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। ফলে নদীর গতিপথ বদলে যাচ্ছে, ঝুঁকিতে পড়ছে ব্যারাজ। ড্রেজার মেশিন অচল ফেলে রেখে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অবৈধ মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, আমরা একাধিকবার লিখিতভাবে জানিয়েছি, কিন্তু অনুমতি আটকে দেয় সেই সিন্ডিকেট।
 

পুলিশ ও র‌্যাবের নথি বলছে, গত এক বছরে ব্যারাজ এলাকা থেকে উদ্ধার হয়েছে ১,২০০ বোতলের বেশি ফেন্সিডিল ও কয়েক হাজার ইয়াবা। স্থানীয়দের প্রশ্ন, শতাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা, আনসার ব্যাটালিয়ন ও পুলিশের পাহারা থাকা সত্তে¡ও মাদক কীভাবে ব্যারাজ অতিক্রম করে? উত্তর মেলেনি কারো কাছ থেকে। দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দুটি স্কেল বছরের পর বছর অকেজো। সচল হলে ২০ টনের বেশি গাড়ি পার হতে পারবে না। তখন সিন্ডিকেটের আয় বন্ধ হয়ে যাবে। রাজনৈতিক প্রভাব আর অসাধু কর্মকর্তাদের কারণে ইচ্ছাকৃতভাবে স্কেল মেরামত আটকে রাখা হয়েছে।
 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিগ্রহণকৃত ৩,৫০০ হেক্টরের বড় অংশ এখন রাজনৈতিক নেতাদের দখলে। ডালিয়া নতুন বাজার, ঝুনাগাছ চাপানী হাটসহ বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে দোকানঘর ও বহুতল ভবন। এমনকি বোর্ডের অবসর কটেজের পাশের পুকুরও দখলে নিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা লোকমান হোসেন। তিনি অকপটে বলেন, আমার ঠ্যাপেই অনেক কিছু হয়। বোর্ডের পুকুরে আমরা মাছ ছাড়ি, তারাও ধরে। এটা কোনো অপরাধ না। 

 
স্থানীয় বাসিন্দা আমিনুর রহমান বলেন, ব্যারাজ রাষ্ট্রীয় সম্পদ। সঠিকভাবে ব্যবহার হলে আমরা সুখে থাকতে পারতাম। কৃষকরা সেচ পেত, পর্যটক আসতো। কিন্তু এখন ব্যারাজ দুর্নীতির আখড়া। 
 

স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিন ৩০০-৪০০ মালবাহী ট্রাক ব্যারাজ অতিক্রম করে, বিশেষ করে পাটগ্রাম ও বুড়িমাড়ী স্থলবন্দর থেকে আসা পাথর, কয়লা ও বালুবোঝাই গাড়ি। এসব থেকে আদায় হওয়া টাকা ভাগ হয় পুলিশ, আনসার, দালাল অফিস ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে। 
 
 
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (যান্ত্রিক) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম বলেন, ব্যারাজের ওপর দিয়ে সর্বোচ্চ ২০ টন পর্যন্ত পরিবহন পারাপারের সুযোগ আছে। স্কেল সংস্কারের চাহিদা দেওয়া হয়েছে। 
 

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (পওর) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী বলেন, ব্যারাজ দিয়ে ভারী গাড়ি চলাচলের কোনো সুযোগ নেই। নিষ্কাশন খাল সংস্কারের জন্য ৩৫টি প্যাকেজে কাজ চলছে, ১০টি শেষ হয়েছে। জমি উদ্ধারে বাজেট প্রাপ্তির পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
 


সংগঠন ‘রিভারাইন পিপল’-এর সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, তিস্তার প্রবাহ ঠিক না থাকায় প্রতিবছর বন্যায় প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। ব্যারাজের অনিয়মে লালমনিরহাট-কুড়িগ্রামসহ পুরো অঞ্চল ঝুঁকিতে পড়ছে। কর্তৃপক্ষের এখনই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
 





 

সম্পাদকীয় :

প্রকাশক ও সম্পাদক : মোঃ গোলাম মাওলা শাওন
মোবাইল : ০১৭১১-০০৬২১৪

অফিস :

প্রধান কার্যালয় : ৩১/১ শরীফ কমপ্লেক্স ৫ম তলা পুরানা পল্টন ঢাকা ১০০০

মোবাইল : ০১৯৯৯-৯৫৩৯৭০

ই-মেইল : [email protected],  [email protected]