ঢাকা , সোমবার, ১৮ অগাস্ট ২০২৫ , ৩ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

১৩৭ বছরের ঐতিহ্যবাহী পানের হাট,কোটি টাকার লেনদেন, দাম নিয়ে হতাশ

নিজস্ব প্রতিবেদক
আপডেট সময় : ২০২৫-০৮-১৮ ২০:০৯:২২
১৩৭ বছরের ঐতিহ্যবাহী পানের হাট,কোটি টাকার লেনদেন, দাম নিয়ে হতাশ ১৩৭ বছরের ঐতিহ্যবাহী পানের হাট,কোটি টাকার লেনদেন, দাম নিয়ে হতাশ
 
বাগেরহাট প্রতিনিধিঃ 
 
বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার টাউন নোয়াপাড়ার ১৩৭ বছরের ঐতিহ্যবাহী পানের হাট দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাটগুলোর অন্য তম। প্রতি হাটে এক কোটিরও বেশি টাকার কেনাবেচা হয় এই হাটে। শীতের মৌসুমে এই এই হাটে দেড় থেকে দুই কোটি টাকারও বেশি বিক্রি হয় এই হাটে।

 
এই হাটে শুধু বাগেরহাট জেলার পাইকাররাই নয় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও ব্যবসায়ীরা ভিড় জমান। ভোর চারটায় শুরু হয় এবং প্রতি হাটে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা খাজনা আদায় করা হয়। সপ্তাহে দুই দিন বৃহস্পতিবার ও রবিবার এই হাট বসে। এই হাট থেকে কিনে নিয়ে তারা বিভিন্ন জেলায় ছোট ছোট হাটে পান বিক্রি করে। তবে দেশের অন্যতম এই বৃহৎ হাটেও এখন আর আগের মতো দাম পাচ্ছেন না চাষিরা। মূল্য কম হওয়ায় অনেকেই হতাশায় ভুগছেন।
 
 
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সবাই যখন ঘুমের ঘোরে ঠিক ভোর চারটায় নোয়াপাড়ার রাস্তায় দেখা যায় কলার পাতায় মোড়ানো পানের গাদা মাথায় বা সাইকেলে করে নিয়ে আসছেন চাষিরা। দুই ঘণ্টার এই হাটে হাজারো মানুষের ভিড় কেউ দরদাম করছেন, কেউ পানের আঁটি বেছে নিচ্ছেন, আবার কেউ ট্রাকে করে মাল তুলছেন দেশের নানা প্রান্তে পাঠানোর জন্য। এখানকার পান শুধু দেশের বিভিন্ন জেলায় নয় বিদেশেও রপ্তানি হয়।

 
তবে এত ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও হাটের অবকাঠামো অত্যন্ত করুণ। নেই ছাউনি ,নেই বাথরুম, নেই পানি বিক্রির নির্দিষ্ট জায়গা। বর্ষায় কাদা ও বৃষ্টিতে হাটে চলাচল করাযায় না।

 
পানচাষী সরদার কামরুল ইসলাম বলেন, এই পান চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করি। আমার ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চা আছে ।কিন্তু বর্তমানে যে পরিস্থিতি চলছেএভাবে চলতে থাকলে হয়তো আমাকে অন্য কিছু করে জীবন চালাতে হবে। বাজার যদি একটু ভালো হতো হয়তো ছেলে-মেয়ে নিয়ে দু’মুঠো ভাত খেতে পারতাম।

 
মোল্লা হাট থেকে আসা রহিম শেখ বলেন, বাজারে এখন পান আছে কিন্তু কেনার লোক নেই। ভোর চারটায় এসেছি এখন ছয়টা বাজে তবুও বিক্রি করতে পারি নি। দুই পোন পান নিয়ে এসেছিলাম বিক্রি করলে ৮০০ টাকা পাব। এখন ভ্যান ভাড়া আর খরচ দিতে হবে বাকি টাকা দিয়ে আমি কি খাবো?

 
রূপসার নৈহাটি থেকে আসা সালাম বললেন, আজকের দিনে চাষীকে কেউই গুরুত্ব দেয় না। কিছুদিন পর এই চাষীরা আর থাকবে না। আমরা রোদে পড়ে বৃষ্টিতে ভিজে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল ফলাই কিন্তু ন্যায্য মূল্য না পেলে চাষী কিভাবে টিকে থাকবে? অনেক চাষী আছে যারা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে।একজন লেবার নিতে গেলে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা খরচ হয়। এই খরচেই আমরা পানের চাষ করি। কিন্তু বাজারে এসে দেখছি বিক্রি করতে গিয়ে লোকসানে পড়তে হচ্ছে।

 
পান চাষি আব্দুল করিম বলেন, আগে এক গাদা পান বিক্রি করে সংসার চালানো যেত এখন সেই দামে লেবারের মজুরিও ওঠে না।

 
আরেক চাষি মিজানুর রহমান বলেন, সুপারির দাম বেড়েছে কিন্তু পানের দাম দিন দিন পড়ছে। এত কষ্ট করে চাষ করি লাভ তো দূরের কথা অনেকে লোকসান গুনছে।

 
নোয়াপাড়ার এই শতবর্ষী হাট কেবল বাণিজ্যের কেন্দ্র নয়, এটি এলাকার মানুষের গর্ব ও পরিচয়। কিন্তু অবকাঠামো উন্নয়ন ও ন্যায্য দাম নিশ্চিত না হলে একদিন এই গৌরবময় ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
 
 
ফকিরহাট টাউন নোয়াপাড়া পান বাজার হাটের ইজারাদার মোঃ তাজুল ইসলাম বলেন,এই পানের হাটের ইতিহাস প্রায় ১৩৭ বছরের। আমি নিজে টানা ৩৩ বছর ধরে এই হাট দেখাশোনা করছি। প্রতিবছর এখানে ১৫ থেকে ১৬ লক্ষ টাকার ডাক হয়। সরকারকে আমরা এই ডাকের টাকা প্রদান করি। সপ্তাহে দুই দিন বৃহস্পতিবার ও রবিবার হাট বসে, আর প্রতিদিনই প্রায় কোটি টাকার পানের বেচাকেনা হয়।

 
কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো কোটি টাকার লেনদেন হলেও হাটের কোনো উন্নয়ন হয়নি। পানি সরানোর মতো কোনো ড্রেন নেই, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেই, নেই টয়লেট বা বাথরুম। ছাউনিগুলো একেবারে জরাজীর্ণ, যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের জন্য ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা নেই বললেই চলে। এমনকি মসজিদের বাথরুমটাও তালা দেওয়া থাকে, ফলে দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষজন চরম দুর্ভোগে পড়েন।

 
আগে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকাররা এখানে আসতেন। এখনো আসেন তবে অব্যবস্থাপনার কারণে আগের মতো ভিড় আর হয় না। তবুও বাগেরহাট জেলার বাইরে থেকেও অনেকেই পান কিনতে আসেন। 

 
এছাড়াও পানের বাজারমূল্য দিন দিন কমছে চাষিরা যে খরচ করে পান চাষ করেন ওইসেই টাকাটাই উঠছে না। একসময়কার লাভজনক এই চাষ এখন অনেকের জন্য লোকসানের খাতায় পরিণত হয়েছে। সুপারি বেশি দামে বিক্রি হওয়ায় তার প্রভাবেও পানের দাম অনেকটা পড়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে পানচাষীরা একসময় টিকে থাকতে পারবে না।

 
ফকিরহাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুমনা আইরিন বলেন, আমি ছয় মাস আগে এখানে যোগদান করেছি আসলে আমার জানা ছিল না যে বাগেরহাটে এত বড় একটি পানের হাট রয়েছে। এখন পর্যন্ত চাষি ও ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। তবে সম্প্রতি বিষয়টি অবগত হয়েছি। শিগগিরই সরেজমিনে গিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করব এরপর হাট-বাজার উন্নয়ন ফান্ড থেকে প্রকল্প গ্রহণ করে সমস্যার সমাধানের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।



 

নিউজটি আপডেট করেছেন : Banglar Alo News Admin

কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ