পারিবারিক বন্ধন কি আদালতে মাপা যায়।
banews
আপডেট সময় :
২০২৫-০৮-০১ ২০:৩১:২২
পারিবারিক বন্ধন কি আদালতে মাপা যায়।
লিখেছেন, অ্যাডভোকেট ইসফাকুর রহমান গালিব।
সম্প্রতি মেহরিন আহমেদ নামের একজন তরুণী তার মা-বাবার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন। সেই মামলা আমি পেশাগত দায়িত্বের অংশ হিসেবে পরিচালনা করেছি। আমার চোখে এই মামলার উৎপত্তির প্রধান কারণ হলো সন্তানের সঙ্গে মা-বাবার আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে না পারা। সেই সঙ্গে তরুণীও তার মা-বাবার আত্মত্যাগ বুঝতে না পারার ভুল করেছেন। যার ফলে শেষ পর্যন্ত প্রতিকার চেয়ে আদালতে আসতে হয়েছে।
আমি বিশ্বাস করি, এই মামলার মাধ্যমে হাজারো মা-বাবা তাদের প্যারেন্টিং, সন্তানকে সময় দেওয়া, সামাজিক শিক্ষা এবং ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপারে আরও সচেতন হবেন। আমাদের দেশে জমি-সংক্রান্ত বহু মামলার প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে মা-বাবা বনাম সন্তান। খোঁজ নিয়ে দেখবেন, এইসব সন্তানের অনেকেই উচ্চশিক্ষিত। এই সমাজে পারিবারিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের সূচনা ঘটে সেদিন, যেদিন প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। খোঁজ নিয়ে দেখবেন, এই বৃদ্ধ মা-বাবার সন্তানেরা অনেকেই সমাজের সবচেয়ে উঁচু পর্যায়ে অবস্থান করছেন।
মূলত সন্তানের জন্য সময় ব্যয় করাই তার সঙ্গে সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক গড়ে তোলার সবচেয়ে কার্যকরী উপায়। এই পথের শুরুতে বাবা-মা দুজনের কাছেই বিষয়টি কঠিন মনে হতে পারে। কিন্তু ধৈর্য ধারণ করলে সময়ের সাথে সাথে সব সহজ হয়ে যায় এবং বাবা-মা হিসেবে সন্তানের প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্ব ও আনন্দময় অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ হয়।
স্বাভাবিক পরিবেশে মা ও শিশুর পারস্পরিক সম্পর্কের মাধ্যমে শিশু যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে, পরিবারের বাইরে বেড়ে ওঠা শিশুরা তা থেকে বঞ্চিত হয়। বিশেষ করে সামাজিকতা যেমন অন্যকে দেখে হাসা, মুখাবয়বের পরিবর্তন, ভাষার বিকাশ ইত্যাদি আচরণ-এইসবই পারস্পরিক সম্পর্কে নির্ভরশীল। মা শিশুর প্রতি এই আচরণ করলে শিশু প্রতিক্রিয়াস্বরূপ মায়ের প্রতিও তেমন আচরণ করে। প্রতিষ্ঠানে লালিত-পালিত শিশুদের বেলায় এই ধরনের উদ্দীপনার অভাব থেকেই যায়, ফলে তারা অনেকসময় অমিশুক, অনুভূতিহীন ও উদাসীন প্রকৃতির হয়ে ওঠে।
অনেক মনোবিজ্ঞানীর মতে, শিশুর জীবনের প্রথম ৩ বছর যদি মায়ের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতিতে কাটে, তাহলে শিশুটি স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং পরে উন্নত পরিবেশে রাখলেও সেই ক্ষতি পূরণ হয় না। পরিবারের বাইরে বেড়ে ওঠা শিশুদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা, আগ্রাসী মনোভাব ইত্যাদি অসামাজিক আচরণ বেশি দেখা যায়।
তবে এ-ও দেখা গেছে, এইসব শিশুকে যথাযথ আদর-যত্ন দিয়ে উপযুক্ত পরিবেশে রাখলে তারাও অন্যান্য শিশুর মতো বিকশিত হয়-এমনকি পরিবারের মধ্যে অবহেলিত শিশুর চেয়ে অনেকদিক থেকে এগিয়েও যেতে পারে।
শুধু ভালো স্কুলে ভর্তি করালেই বা বাড়ি-গাড়ি কিনে দিলেই সন্তান মানুষ হবে-এটা ভুল ধারণা। সন্তানের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন, যেন সন্তান ও মা-বাবা একে অপরের সুখে হাসতে পারে, দুঃখে কাঁদতে পারে। মনে রাখতে হবে, একজন সন্তানের সবচেয়ে বড় শিক্ষক তার পরিবার। সে পরিবার থেকে যা শিখবে, ভবিষ্যতে তাই সে সমাজকে ফিরিয়ে দেবে।
প্রত্যেক বাবা-মা ও অভিভাবকের উচিত সন্তানদের যথাযথভাবে পরিচর্যা করা, তাদের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলা। মুসলিমদের ক্ষেত্রে পবিত্র কোরআন ও হাদীসের আলোকে সুশিক্ষায় গড়ে তোলা অপরিহার্য। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রেও ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব মা-বাবার ওপরই বর্তায়। ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে সন্তান আরও মানবিক হয়ে ওঠে।
বলা বাহুল্য, পরিচর্যার প্রতিটি বিষয় সময়মতো করতে হয়। সঠিক সময়ে তা না করলে পরে তা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। শিশুকালে বাচ্চাদের মন-মানসিকতা থাকে কোমল ও গ্রহণযোগ্য, যা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর আর থাকে না। শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য খাদ্য, নিরাপত্তা, শিক্ষা ছাড়াও খেলাধুলা, আনন্দ-বিনোদন ও নিজ ধর্ম-সংস্কৃতির চর্চা প্রয়োজন। এতে করে মূল্যবোধ ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটে এবং ভবিষ্যৎ বিশ্বনাগরিক হিসেবে শিশুরা গড়ে ওঠে।
সন্তানদের খুনসুটি, প্রশ্ন-উত্তর, ভালোবাসা ও যুক্তির মাধ্যমে সঠিক-ভুল শেখানো বাবা-মায়ের দায়িত্ব। প্রয়োজনে কঠোরতাও জরুরি, তবে ভালোবাসা হতে বিচ্যুত না হয়ে।
সন্তানদেরও বোঝা উচিত-মায়ের স্নেহ, বাবার আদর একটি মানুষের দুঃখ দূর করতে যে শক্তি রাখে, পৃথিবীর আর কোনো কিছু তা পারে না। সেই মা-বাবাকে কষ্ট দিলে তারা কখনো আপনাকে ত্যাগ করতে পারবেন না, কারণ আপনি ছাড়া তাদের আর কোনো বিকল্প নেই। আপনার দুঃখ যেমন আপনার কাছে বেদনাদায়ক, তেমনি আপনার দ্বারা সৃষ্ট কষ্টও তাদের জন্য গভীর যন্ত্রনার কারণ হয়, যা আপনাকেও আজীবন নাড়া দিতে পারে।
আমি নিজেও জীবনে বহু মানুষের কষ্ট দেখেছি, যার অন্যতম কারণ ছিল মা-বাবাকে কষ্ট দেওয়া। আমাদের আচরণ সবসময় হতে হবে মার্জিত, বিনয়ী ও শ্রদ্ধাশীল। আমাদের সফলতা শুরু হোক মা-বাবাকে ভালোবেসে, জয় করে।
আপনার প্রতি মা-বাবার ভালোবাসা, তাদের ত্যাগ আর শৈশবের সুখস্মৃতিগুলো বারবার মনে আনুন। মা-বাবার প্রতি রাগ আসলে, সেই স্মৃতিগুলো স্মরণ করুন। দেখবেন, সেই সুন্দর মুহূর্তগুলো আপনার রাগকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আপনিও তাদের প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল ও বিনয়ী হয়ে উঠবেন। আপনার এই মনোভাব আপনার মা-বাবাকেও স্পর্শ করবে। তখন দেখবেন, পারিবারিক সম্পর্ক অনেক সহজ ও সুখকর হয়ে উঠেছে।
পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য আইনজীবী হিসেবে আমাদের কখনো মা-বাবার, আবার কখনো সন্তানের পক্ষ নিয়ে আদালতে দাঁড়াতে হয়, যা একজন মানুষ হিসেবে অত্যন্ত বেদনাদায়ক। পরিবারে আলোচনার মাধ্যমে এসব ভুল বোঝাবুঝির সমাধান হওয়া উচিত। আদালত পর্যন্ত বিষয়টি গড়ানো সত্যিই দুঃখজনক।
আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Banglar Alo News Admin
কমেন্ট বক্স