রাজশাহীর তানোরে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প বিলুপ্তপ্রায়
আপডেট সময় :
২০২৫-০৬-২২ ০৯:৪৪:০৭
রাজশাহীর তানোরে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প বিলুপ্তপ্রায়
মাসুদ রানা রাব্বানী, রাজশাহী: রাজশাহীর তানোরে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প বিলুপ্তপ্রায়। কালের বিবর্তন, আধুনিকতার ছোঁয়া ও মানুষের রুচির পরিবর্তনের ফলে মাটির তৈরি সামগ্রীর স্থান দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিক, মেলামাইন, স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি নানা রকম আধুনিক সামগ্রী। এ কারণে চাহিদা কম, কাঁচামালের দুস্প্রাপ্যতা, শ্রমিক সংকট ও চড়ামূল্য, সর্বোপরি পুঁজির অভাবে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তানোরের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প।
জানা গেছে, ইতিহাস ঐতিহ্যের পাতায় চোখ রাখলেই দেখা যাবে, মৃৎশিল্পের জন্য তানোর একসময় ছিল খুবই পরিচিত। কিন্তু কালের আবর্তে আজ তা বিলীন হতে চলেছে। ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে এ পেশার আকাল। হয়তো বা এমন দিন আসবে, যেদিন বাস্তবে এ পেশার অস্তিত্ব মিলবে না। শুধুমাত্র খাতা-কলমেই থাকবে সীমাবদ্ধ।
এদিকে তানোর পৌরসদরের পালপাড়া মহল্লায় গিয়ে দেখা যায়, এ পেশার অনেকেই এখন পৈতৃক পেশা ছেড়ে দিয়ে কেউ মুদিদোকান, চা স্টল, ফার্ম্মেসী আবার কেউ দিনমজুরের কাজ করছেন। উপজেলার কামারগাঁ ইউনিয়নের (ইউপি) কামারগাঁ পালপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, একইচিত্র।
স্থানীয়রা জানান, যারা বংশপরম্পরায় এখানো এ পেশা ছাড়তে পারেননি, তাদের অনেকেই শিক্ষা, চিকিৎসাসহ আধুনিক জীবনযাত্রার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। মৃৎশিল্পীরা জানান, বর্তমানে মানুষের ব্যবহারিক জীবনে মৃৎশিল্পের আর বিশেষ ভুমিকা নাই।
অথচ একটা সময় ছিল যখন মাটির তৈরি হাঁড়ি- পাতিল, থালা-বাসন, সানকি, ঘটি, মটকা, সরা, চারি, কলস, সাজ, ব্যাংক, প্রদীপ, পুতুল, কলকি, দেবদেবীর মূর্তি, টাইল ও ঝাঝরের বিকল্প ছিল না। ঋণ প্রদানে অনীহা ও প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা আর প্রযুক্তি বিকাশের এ যুগে এ শিল্পের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধিত না হওয়ায় তা আজ আর প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না।
ফলে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অনেকে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। আগেকার দিনে মৃৎশিল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন এঁটেল মাটি, রঙ, যন্ত্রপাতি ও জ্বালানি ছিল সহজলভ্য। কিন্তু বর্তমানে এসব প্রয়োজনীয় উপকরণের দুমূর্ল্যের কারণে তারা হিমশিম খাচ্ছেন।
পূর্বে যেখানে বিনামূল্যে মাটি সংগ্রহ করা যেত, বর্তমানে এ মাটিও অগ্রিম টাকায় কিনতে হচ্ছে। সাধারণত মৃৎপাত্রগুলো কুমার পরিবারের নারী- পুরুষ উভয়ে মিলেমিশে তৈরি করে থাকেন। তৈরিকৃত সামগ্রী বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা এসে কিনে নেন। অনেকে আবার বাড়ি বাড়ি ফেরি করে বিক্রি করেন। বর্ষা মৌসুমে কাজ বন্ধ থাকায় মৃৎশিল্পীদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ যায়। এ সময় কুমাররা সারা বছর কাজ করার জন্য এঁটেল মাটিসহ প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহে নেমে পড়েন।
তবে যাদের নৌকা আছে তারা বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে মাটির তৈরী তৈজসপত্র বিক্রি করেন। অন্যদিকে পুঁজির অভাবে অনেকে মহাজনের কাছ থেকে চড়াসুদে টাকা ঋণ নেন। শুষ্ক মৌসুমে কাজ করে যা উপার্জন হয় তার বেশির ভাগই চলে যায় মহাজনের ঋণ পরিশোধ করতে। এভাবে মৃৎশিল্পীরা যুগযুগ ধরে থেকে যাচ্ছেন সহায় সম্বলহীন হয়ে। এদিকে কালের বিবর্তনে মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য আজ বহুলাংশে বিলুপ্ত হচ্ছে।
শুধু তানোর নয়, গোটা বরেন্দ্র অঞ্চলে এ পেশায় নেমে এসেছে নেমে এসেছে এক চরম বিপর্যয়। এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখার ব্যাপারে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। অথচ এ শিল্পের মাধ্যমে একদিকে যেমন আমরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবো, তেমনিভাবে প্রাচীন সভ্যতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে এ পেশাটি। এর মাঝেই জাতির ইতিহাস খুঁজে পাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Banglar Alo News Admin
কমেন্ট বক্স